গ্রাম আদালতের মামলার রায়ের সাফল্য অনেক বেশি
রিনা আর মোরশেদ এর পরিচয় কর্মসূত্রে। আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে মধুর সম্পর্ক। অতপর ভালবেসে ফেলে দুজন দুজনকে। গভীর প্রেমে চলতে থাকে দুজনের জীবন। সেই প্রেমকে বিয়েতে রূপ দিতে দুই পরিবারকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন দুজনেই। কিন্তু মানে না কেউ। অবশেষে দুজনে সিদ্ধান্ত নেন, পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করবেন। শেষ পর্যন্ত ৬ লাখ টাকা কাবিনমূলে আদালতে গিয়ে বিয়ে করে উঠেন একটি ভাড়া বাসায়। কিন্তু সেই সংসার ঠেকেনি ৫ মাসও। স্বামীর শারীরিক নির্যাতনে নববধূ চলে আসেন বাড়িতে।
এই নববধূ রিনা আকতার (১৮) চট্টগ্রামের আনোয়ারার জুঁইদন্ডী এলাকার মোহাম্মদ হায়দার আলীর কন্যা। অন্যদিকে তার স্বামী মোরশেদ আলম (২৬) কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের কেরানী বাড়ির মোহাম্মদ মীর আহমদের পুত্র।
এ নিয়ে বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদে মামলা করা হয়। এরপর সেখান থেকে নোটিশ জারি করা হলে গত শনিবার (২৮ আগস্ট) উভয়পক্ষ গ্রাম আদালতে হাজির হন। সেখানে উভয়পক্ষের কথা শোনেন আদালতের সদস্যরা। এতে ঘটনার বিষয়টি গ্রাম আদালতের কাছে স্বীকার করেন বর মোরশেদ।
পরে আদালতের বিচারক ও বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম জরিমানা ধার্য করে। পরে জরিমানার টাকা আদালতকে জমা দিলে আদালত উভয়পক্ষ সে সিদ্ধান্ত হাসিমুখে মেনে নেন। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর রিনা আকতারকে বধূ সাজিয়ে ঘরে তুলে নেওয়ার কথা দেন বর মোহাম্মদ মোরশেদ।
ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, পরিষদের গ্রাম আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে অর্ধশত নারী-পুরুষ। করোনা ভাইরাসজনিত লকডাউনের কারণে গ্রাম আদালত বন্ধ থাকায় অনেক মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াতে ভীড় বেড়ে যায়।
সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এ ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের দিন ধার্য্য থাকলেও মামলা নিষ্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম শনিবার গ্রাম আদালত বসার উদ্যোগ নেন। শুধু বিবাহ বিচ্ছেদের বিরোধ মীমাংসা ছাড়াও দেখা গেছে চুরি, ঝগড়া-বিবাদ, কলহ বা মারামারি, প্রতারণা, পাওনা টাকা আদায়, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে এ আদালতে।
গৃহবধূ রিনা আকতার জানান, ‘এক বছর আগে পার্শ্ববর্তী বড়উঠান এলাকার মোরশেদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক থেকে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে পরিবর্তন হয়ে যায় স্বামীর আচার-আচরণ। বিভিন্ন সময়ে করে মারধরও। পরিবারের মতামত না নিয়ে করেছেন বিয়ে। অভিমানে চলে আসেন বাপের বাড়িতে। এরপর থেকে স্বামী তার খোঁজ-খবর নেয়নি। স্বামীর সাথে যোগাযোগ করা হলে সে নানা ধরনের তালবাহানা করে। পরে বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদে মামলা করা হয়। সেই মতে শনিবার উভয়পক্ষ গ্রাম আদালতে হাজির হয়। সেখানে উভয়পক্ষের কথা শুনে গ্রাম আদালতের সদস্যরা সমস্যার সমাধান করে দেন। উভয়পক্ষ সেই সিদ্ধান্ত হাসিমুখে মেনে নেন।’
এমন আরও বেশ কয়েকটি মামলা নিষ্পত্তি করা হয় এবং কয়েকটি মামলা সাক্ষীর জন্য রাখা হয়। এভাবেই চলছে এ ইউনিয়নের গ্রাম আদালতের বিচার কার্যক্রম।
সূত্র জানিয়েছে, ‘এ আদালতে প্রতিনিধি মনোনয়নে আবেদনকারী ও প্রতিবাদী সমান সুযোগ এবং নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। আইনজীবীর দরকার হয় না। সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় নতুন করে বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা নেই এবং বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ মিলছে। এ কারণে বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রাম আদালত আইন-২০০৬ অনুযায়ী, ছোটখাটো ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিরোধ স্থানীয়ভাবে মিমাংসার জন্য গ্রাম আইন করা হয়। প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত পরিচালনার বিধান থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ ইউনিয়নে আদালতের কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। কোনো বিচার প্রার্থী ইউনিয়ন পরিষদে গেলে তা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে গিয়ে নানা বিপত্তির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু ভিন্ন নজির সৃষ্টি করেছে বড়উঠান ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল আলমের।
জানা গেছে, সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার নিয়মিত আদালত বসে এ ইউনিয়নে। আদালতের আদলেই মামলাগুলো আমলে নেওয়া এবং আদালতের পাঁচ সদস্যের অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে একের পর এক সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এরপর খুশি মনে ফিরতে দেখা যায় মামলাগুলোর উভয়পক্ষের বিচারপ্রার্থীদের। গ্রাম আদালত চুরি, ঝগড়া-বিবাদ, কলহ বা মারামারি, প্রতারণা, পাওনা টাকা আদায়, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায়, গবাদি পশু সংক্রান্ত এবং নারীকে অমর্যাদা বা অপমান করাসহ ১৫টি বিষয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে। সে আলোকে বড়উঠান ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে গ্রামীণ স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে নারীসহ দরিদ্র ও বিপদগ্রস্থ সবমানুষ আইনি সহায়তা পাচ্ছে। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের বিরোধগুলো স্বল্প খরচ ও স্বচ্ছতার সাথে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।
কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল আলম জানান, সরকারি সেবা মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন, গ্রাম আদালত তার একটি। সাধারণ মানুষ এখন আর ছোটখাটো বিরোধ নিয়ে উচ্চ আদালতে না গিয়ে তারা গ্রাম আদালতে বিচার চাইছে। এর মাধ্যমে গ্রামের লোকজন তার এলাকাতেই নিজেদের মধ্যে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পাচ্ছেন। এ কারণে গ্রাম আদালতকে সক্রিয় এবং কার্যকর রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ‘উচ্চ আদালতগুলোতে যেখানে একটি মামলা বছরের পর বছর পড়ে থাকছে, সেখানে গ্রাম আদালতে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। আশা করি মামলার জট নিরসনে গ্রাম আদালত অন্যদের পথ দেখাবে।’
Discussion about this post