ঢাকার ধামরাইয়ে অবৈধভাবে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি, কয়েকটি ড্রেজার ও একাধিক মাটির লিকে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ ।
ধামরাইয়ে চৌহাট ও বালিয়া ইউনিয়নে, ইমরান ও নাহিদ কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে এবং পেশীশক্তির বলে ভেকু মেশিন দিয়ে তিন ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। এতে সরিষা ও গমসহ মৌশুমী ফসলের জমির মাটি প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় ইটভাটায়। এতে জমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে পুকুরে পরিণত হচ্ছে একসময়ের তিনফসলি জমি। জমি এভাবে গভীর করে মাটি কাটার ফলে আশপাশের জমিও ভেঙে পড়ছে। ফলে ওই জমির মাটিও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে বিশাল এলাকা ফসলশুণ্য হয়ে পড়ায় ভবিষ্যত খাদ্য নিরাপত্তার আশংকা করা হচ্ছে।
জনবসতি থেকে কিছুটা দূরে নির্জন এলাকায় দূর থেকে চোখে পড়বে ছোট ছোট সাদা রঙের ঢিবি। দেখতে সুন্দর হলেও মাটি, ইট ও কাঠের গুড়া দিয়ে বানানো এসব ঢিবি মূলত বন উজারের মাধ্যম। স্থানীয়রা এটিকে চুলা বা চুল্লি বলেই চেনে। নির্বিচারে কেটে আনা মণকে মণ গাছ এসব চুল্লিতে পুড়িয়ে বানানো হয় কয়লা। আর নির্গত ধুয়ায় দূষণ ছড়াচ্ছে পরিবেশে। পাশাপাশি হুমকিতে পড়ছে জনজীবন ও জীববৈচিত্র। এসব অবৈধ চুল্লির মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহস পায়না কেউই। এমনকি অসাধু চুল্লি মালিকদের প্রসঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও শোনাচ্ছেন নরম সুর। তবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে দ্রুত এসব চুল্লি ভেঙে ফেলার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। ঢাকার ধামরাই উপজেলার দুটি ইউনিয়নে এমন প্রায় ১৫-২০টি চুল্লির সন্ধান পাওয়া গেছে। বনের কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির এমন প্রক্রিয়া অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও এসব এলাকার বাসিন্দাদের কাছে পুড়নো। বছরের পর বছর এসব চুল্লিতে টনকে টন গাছ কেটে পোড়ানো হলেও প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারও। ওই ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরাও সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সাহস দেখায় না। তাইতো বনভূমি উজারকারীরা দিনের পর দিন হয়ে উঠছেন বেপরোয়া।
উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে প্রকাশ্যে অবাধে বনের কাঠ পোড়ানোর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। বালিয়া ইউনিয়নের বাস্তা গ্রামে আরও ছয়টি চুল্লির মালিক নাহিদ রানা ও মো. ইমরান। চুল্লি গুলোর সামনে কেটে রাখা হয়েছে মণকে মণ বনের গাছ। প্রতিটি চুল্লিতে ২০০-৩০০ মণ কাঠ প্রবেশ করিয়ে আগুন দেয়ার পর খোলা অংশটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর টানা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কাঠ পোড়ানো শেষ হলে কয়লা বের করা হয়। একেকটি চুল্লি থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার কয়লা পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব এলাকার অনেক বাসিন্দারা এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। তারা বলেন, বছরের পর বছর এসব চুল্লিতে কাঠ পোড়ানো হয়। কাঠ গুলো আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করেন চুল্লির মালিকরা। যখন কাঠ পোড়ানো শুরু হয় চুল্লি থেকে প্রচন্ড ধোয়ার কুন্ডলী বের হতে থাকে। এতে আশপাশের পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এসময় বয়োবৃদ্ধ, শিশু সহ অনেকের শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে চোখ জ্বালাপোড়া করে। গোপনে অনেকে প্রতিবাদ করলেও প্রকাশ্যে বলার সাহস পায় না। কারণ এসব চুল্লির মালিকরা প্রভাবশালী।
ধামরাই পরিবেশ আন্দোলনের আহ্বায়ক সিয়াম সারোয়ার জামিল বলেন, যত্রতত্র অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা এসব কয়লা কারখানা পরিবেশের জন্যে হুমকি স্বরূপ। এগুলো থেকে সারা দিন ধোঁয়ার কুন্ডলী নির্গত হচ্ছে। একেতো নির্বিচারে গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করে এখানে পোড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে ধোঁয়ার মাধ্যমে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি ।
বালিয়া ইউনিয়নের বাস্তা গ্রামের ড্রেজার, মাটির লিক ও চুল্লির মালিক নাহিদ ও ইমরান বেপরোয়া ভাবে বলেন, কারও মাটি জোর করে কাটছিনা। ফসল না হলে মাছ চাষ করে কৃষক অধিক লাভবান হবে। বালু উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ধামরাই উপজেলায় অনেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে বিক্রি করছে। এ কারণে আমিও বালু তুলে ব্যাবসা করছি। পরিবেশ দূষন করে অবৈধভাবে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে, দেখেন ওনে ছয়ডা না কয়টা চুলা আছে? ছয়টা থাকলে ছয়ডাই আছে। ইটখোলাতো চলতেছে, ওগলাইতো পরিবেশ দূষণ হয়। আমারডা অবৈধ। সব অবৈধ ব্যবসা । যেমুনে চালাইতে পারি চালাই। না পারলে বন্ধ থাকবো।’ নাহিদের সঙ্গী আরেক মালিক মো. ইমরান বলেন, ‘ওহানে যা আছে আমাগো দুই জনেরই। পাঁচটা চুলা আছে। কত গুলা কয়লা হয় হিসাব নাই। একেক সময় একেক রকম বাইর হয়। কাঠ বিভিন্ন জায়গা থাইকা বেপারী আইসা দিয়া যায়।’ আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এই অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওইগলা সব আমার পার্টনার নাহিদ জানে।’
বালিয়া ইউনিয়নে বাস্তা গ্রামের কয়েকজন বলেন, বালু দস্যুরা এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বাধা দেয়ার সাহস করে না। এরা ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদীর গভীর থেকে বালু উত্তোলন করছে। এতে গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় বংশি নদীর পাড়ের ঘরবাড়ি সহ শত শত বিঘা আবাদি জমি ভাঙনের মুখে পড়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, ইমরান ও নাহিদের অবৈধভাবে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি, কয়েকটি ড্রেজার ও একাধিক মাটির লিকে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। ড্রেজিং পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করা হলে ভরা বর্ষায় তাদের বসত ভিটা ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলন হবে।
বালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বলেন, এর বিরুদ্ধে ওই গ্রামের লোকজনকে আইডিয়া দিছি। তারা এসবের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরও নিয়েছেন। অন্যদের মাধ্যমে জিনিস গুলা বন্ধ করে দেয়া যায় কি না? সরাসরি ডাইরেক্ট আমি না যাইয়া। অন্যদের দিয়া অভিযোগ করাইয়া।’
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বলেন, সম্প্রতি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে । অভিযান অব্যাহত রয়েছে।বেশ কয়েকটি অবৈধ মাটির লিক,কয়েকটি ড্রেজারকে জরিমানা করেছি , কাঠ পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করে কয়লা তৈরির বিষয়ে জানতে পেরেছি দ্রুত ব্যাবস্থা নিব । অবৈধভাবে কৃষি জমির মাটি কাটা ও ড্রেজারের বিরুদ্ধে এই অভিযান চলবে।
Discussion about this post